সম্পাদকীয় | ১ মে ২০২৫
১ মে, মহান মে দিবস— একটি দিন, যাকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে উচ্চারিত হয় ন্যায়, সমতা ও শ্রমের মর্যাদার কথা। ১৮৮৬ সালের শিকাগো শহরে “৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম, ৮ ঘণ্টা ব্যক্তিগত সময়”—এই দাবি নিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তা পরিণত হয় এক বৈশ্বিক বিপ্লবের রূপে। কিন্তু সেই বিপ্লবের চেতনা আজ কোথায় দাঁড়িয়ে? বিশ্বায়নের কোলঘেঁষে দাঁড়ানো বাংলাদেশে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের বালুভূমিতে ঘাম ঝরানো প্রবাসী শ্রমিকদের চোখে কি আজও সেই সম্মান প্রতিফলিত?
বাংলাদেশের শ্রমিক বাস্তবতা: শূন্য থেকে রাষ্ট্র গঠনের কারিগর
বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক ৬.৩ কোটি কর্মক্ষম শ্রমজীবী মানুষ আছেন (BBS, 2024)। এর মধ্যে ৮৫% শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে নেই চাকরিচুক্তি, সামাজিক সুরক্ষা, বা স্বাস্থ্য সেবা। এই শ্রমিকরাই কাজ করেন কৃষি, পরিবহন, নির্মাণ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, হকার, দিনমজুর—এমন অগণিত খাতে।
বিশেষভাবে নজরে আসে গার্মেন্টস খাত। যেখানে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক, তার মধ্যে ৮০% নারী। তাদের অনেকেই দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করেন, যার অনেকটাই দাঁড়িয়ে, ঘামে ভেজা, মানসিক চাপে জর্জরিত অবস্থায়।
২০২৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পোশাক শ্রমিকদের মাসিক আয় গড়ে ৮,২০০ টাকা, অথচ এক পরিবারের ন্যূনতম জীবনমান রক্ষা করতে প্রয়োজন প্রায় ১৭,০০০ টাকা। তদ্ব্যতীত, উৎসব বোনাস, ওভারটাইম বা মাতৃত্বকালীন ছুটি অনেক ক্ষেত্রেই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।
শ্রমিক নয়, আত্মত্যাগী যোদ্ধা: রানা প্লাজার স্মৃতি কি মুছে গেছে?
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান ১,১৩৪ জন শ্রমিক—আহত হন সহস্রাধিক। তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ১১২ জন। এসব দুর্ঘটনার পর নিরাপত্তা সংস্কার নিয়ে বহু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, বাস্তবে বাংলাদেশ এখনো নিরাপদ শিল্প ব্যবস্থার মানদণ্ডে অনেক পেছনে। ২০২৪ সালের একটি BILS রিপোর্ট বলছে, বছরে গড়ে ১১০-১৩০ শ্রমিক প্রাণ হারান বিভিন্ন দুর্ঘটনায়, অধিকাংশই নির্মাণ ও পোশাক খাতে।
প্রবাসী শ্রমিক: বৈদেশিক মুদ্রা আনার বাহক, অথচ অবহেলিত নাগরিক
বাংলাদেশ থেকে আজ পর্যন্ত ১ কোটির বেশি মানুষ প্রবাসে পাড়ি দিয়েছেন কর্মসংস্থানের আশায়। তাদের রেমিট্যান্স এখন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয় উৎস—২০২৪ সালে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সেই শ্রমিকেরা কোথায় থাকেন? কত ঘন্টা কাজ করেন? কোনো নিরাপত্তা পান কি না—এসব প্রশ্ন থেকেই যায়।
প্রতি বছর গড়ে ৩,৫০০–৪,০০০ প্রবাসী শ্রমিকের মরদেহ দেশে ফেরে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ অজানা থাকে, ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ বা সহানুভূতি ছাড়া। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেতন বকেয়া, পাসপোর্ট আটকে রাখা, মানবপাচার ও যৌন হয়রানির মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি ঘটে প্রতিনিয়ত। ILO অনুযায়ী, ৬৭% প্রবাসী শ্রমিক নিজ দেশে ফিরে বেকার ও ঋণগ্রস্ত অবস্থায় থাকে।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
বাংলাদেশে শ্রম আইনের আধুনিক সংস্করণ হয়েছে ২০১৮ সালে। তবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে গেলেই শ্রমিকরা পড়ে মালিকপক্ষের রোষানলে। বহু জায়গায় এখনো শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠন “মালিকের অনুমতি নির্ভর” হয়ে আছে—যা সরাসরি ILO চুক্তিভঙ্গ।
অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকদের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা নীতি নেই। শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড আছে, কিন্তু এর অর্থ প্রবাহ ও বাস্তব প্রয়োগে ঘাটতি প্রচুর।
বিশ্ব বাস্তবতায় শ্রমিকের অবস্থান
বিশ্বব্যাপী শ্রমিকরা আজও লড়াই করছেন:
- চীন ও ভিয়েতনামে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন ক্রমবর্ধমান।
- কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে মারা গেছেন হাজারো দক্ষিণ এশীয় শ্রমিক।
- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে ট্রেড ইউনিয়ন ও স্ট্রাইকের মাধ্যমে শ্রমিকরা অর্জন করছেন অবাধ শ্রম অধিকার।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন এখনো অনেক পিছিয়ে—যেখানে অধিকাংশ শ্রমিক জানেই না তার অধিকার কী।
শ্রমিকের চেতনায় রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ
শ্রমিক শুধু একজন মজুর নয়, সে একজন সন্তান, একজন মা-বাবা, একজন স্বপ্নবান মানুষ—যার ঘাম ছুঁয়ে উঠে দাঁড়ায় শহর, রাস্তা, বিল্ডিং, বন্দরে দাঁড়ানো কন্টেইনার, কিংবা বিদেশে রেমিট্যান্স পাঠানো ATM বুথ।
এই শ্রমিকদের ত্যাগে গড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন যদি শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে ব্যর্থ হয়—তবে তা প্রকৃত উন্নয়ন নয়, তা একটি “নির্মম প্রবঞ্চনা”।
আমাদের করণীয়
১. গার্মেন্টস, নির্মাণ ও পরিবহন খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন।
২. অনানুষ্ঠানিক খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো তৈরি।
৩. নারী শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন সহায়তা ও শিশুশিক্ষা সেবা।
৪. বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক বিমা ও দূতাবাস সেল।
৫. শ্রমিক আদালত ও শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
৬. টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অনুযায়ী, সকল শ্রমিকের জন্য নিরাপদ ও সম্মানজনক কাজ নিশ্চিত করা।
উপসংহার: শ্রমিক বাঁচলে দেশ বাঁচে—এটা স্লোগান নয়, বাস্তবতা
মে দিবস একদিনের অনুষ্ঠান নয়—এটি ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা। এটি আত্মত্যাগের স্মরণ, কিন্তু কেবল স্মরণ করলেই চলে না—চলে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করায়।
এই দেশের সব শ্রমিক যেন অন্তত একদিন বলতে পারে— “আমার ঘাম বৃথা যায়নি। আমার সন্তানেরা আমার চেয়ে ভালো থাকবে।”
তাদের মুখে এই হাসি ফোটানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সমাজের, এবং আমাদের সবার।
শুভ মহান মে দিবস। শ্রমিকের প্রতি শ্রদ্ধা নয়, অধিকার দিন। কারণ তারা রাষ্ট্রের ভিত্তি, আর ভিত্তি যদি নড়ে—তাহলে উন্নয়নের দেয়াল টিকবে না।