পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়, যা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘদিনের সংঘাত নিরসনে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই চুক্তির প্রধান লক্ষ্য ছিল পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। নিচে চুক্তির মূল পয়েন্টগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ
চুক্তির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ। চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ (Regional Council) এবং তিনটি জেলা পরিষদ (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) গঠন করা হয়, যার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের উন্নয়ন ও শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সদস্যরা স্থানীয় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন, যা এই অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করে।
২. পার্বত্য ভূমি পুনরুদ্ধার
পার্বত্য এলাকার ভূমি সমস্যা ছিল দীর্ঘদিনের একটি বিরোধপূর্ণ বিষয়। চুক্তির মাধ্যমে গঠিত একটি ভূমি কমিশন পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। চুক্তিতে বলা হয়, আদিবাসী পরিবারগুলো, যারা অতীতে তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল, তাদের জমি ফেরত দেওয়া হবে এবং ভূমি সংক্রান্ত অভিযোগের ন্যায্য ও সুষ্ঠু সমাধান করা হবে। এই কমিশন ভূমি বিরোধের তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে এবং জমির মালিকানা নিশ্চিত করবে।
৩. সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার
চুক্তির একটি বড় অংশ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার। এর মাধ্যমে সেনা উপস্থিতি হ্রাস করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা অঞ্চলটির মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দেয়। অপ্রয়োজনীয় সেনা ক্যাম্পগুলো ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলা হয় এবং শুধুমাত্র প্রধান সেনা ক্যাম্পগুলো রাখা হয়, যেগুলো দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় ছিল।
৪. আদিবাসী সংস্কৃতি ও অধিকার স্বীকৃতি
চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তা এবং তাদের সাংস্কৃতিক অধিকার স্বীকৃত হয়। তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবনধারার প্রতি সম্মান জানিয়ে চুক্তিতে তাদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য নিজেদের পরিচিতি এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণে একটি বড় সাফল্য ছিল।
৫. সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ এবং অস্ত্রবিরতি
শান্তি চুক্তির শর্তানুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (PCJSS) এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র ছেড়ে দেয় এবং রাষ্ট্রের সাথে একতাবদ্ধ হয়। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় এবং তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি বড় পদক্ষেপ ছিল, যা সহিংসতা কমাতে সহায়ক হয়।
৬. উন্নয়ন প্রকল্প এবং অর্থনৈতিক সহায়তা
চুক্তি অনুযায়ী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। এতে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গৃহীত হয়। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই এলাকায় সরকারি সহায়তা এবং প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়।
চুক্তির প্রভাব:
এই চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে মূলধারায় ফিরে আসে এবং দীর্ঘমেয়াদী সহিংসতার সমাপ্তি ঘটে। তবে, এই চুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং কিছু অংশ নিয়ে দ্বন্দ্ব ও অভিযোগ থেকে যাওয়ায় সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয়নি। তবুও, এটি শান্তি প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
চুক্তিটি বাংলাদেশের ইতিহাসে শান্তি ও সমঝোতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত, যা দেশে সামগ্রিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে।