চলুন শুরু করি পার্বত্য প্রতিচ্ছবি ধারাবাহিকের পর্ব ৭, যেখানে আমরা বিশ্লেষণ করবো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বান্দরবানের কৌশলগত গুরুত্ব— বিশেষ করে ভারত, চীন ও মায়ানমারের ভূরাজনৈতিক আগ্রহ, এবং বাংলাদেশের জন্য এর সম্ভাব্য ঝুঁকি ও সুযোগ।
পার্বত্য প্রতিচ্ছবি
পর্ব ৭: আন্তর্জাতিক আগ্রহ ও ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব
বান্দরবানের চারপাশে ছায়া ফেলে থাকা শক্তিগুলোর খেলা
পার্বত্য চট্টগ্রামের জটিলতা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নয়— এর চারপাশে এমন তিনটি রাষ্ট্রের অবস্থান, যাদের কৌশলগত আগ্রহ, নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং অর্থনৈতিক হিসাব— বান্দরবানকে পরিণত করেছে একটি ‘জিওস্ট্র্যাটেজিক হটস্পট’-এ।
🛡️ ভারতের দৃষ্টিকোণ: নিরাপত্তা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে সংযুক্ত করেছে একটি সংকীর্ণ করিডর— “সিলিগুড়ি করিডর” বা “চিকেন নেক” নামে পরিচিত।
ভারত চায়:
- বান্দরবানের সীমান্ত এলাকা অস্ত্র, জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় না হোক
- বাংলাদেশের মাটিতে থাকা জাতীয়তাবাদী বা বিদ্রোহী গ্রুপগুলো যেন ভারতের সীমান্তে হস্তক্ষেপ করতে না পারে
📌 KNF বা পূর্বে ভারত-বিরোধী গোষ্ঠীদের বান্দরবান অঞ্চলে প্রশিক্ষণ বা আস্তানার গুজব ভারতকে করে তোলে সন্দিহান।
📌 ভারতের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি ‘সফট বাফার জোন’, যা নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ব্যারোমিটার।
🐉 চীনের কৌশল: অর্থনৈতিক করিডর ও কূটনৈতিক ব্যালান্স
চীন বান্দরবানকে দেখে মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার ও চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডরের প্রাকৃতিক সম্প্রসারণ হিসেবে।
চীনের আগ্রহ:
- বাংলাদেশে বন্দর, সড়ক, বিদ্যুৎ ও সামরিক সহযোগিতা বাড়ানো
- বান্দরবান ও টেকনাফ–রাঙামাটি–চীনের কুনমিং পর্যন্ত সম্ভাব্য বাণিজ্য রুট
- মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তে সড়ক ও রেল প্রকল্পে বিনিয়োগ
📌 তবে এতে ভারতের উদ্বেগ বাড়ছে, কারণ ভারত মনে করে—
চীন বাংলাদেশে আধিপত্য বাড়াতে চায় ‘উন্নয়নের বন্ধু’ সেজে।
🛶 মায়ানমারের বাস্তবতা: সংঘাত, রোহিঙ্গা, ও ছায়াযুদ্ধ
মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘাতের কারণে বান্দরবান হয়ে রোহিঙ্গা ও রাখাইন গোষ্ঠীর ঢল নামে।
মায়ানমারের দৃষ্টিতে:
- বাংলাদেশ “মানবিক করিডর” নামে রাখাইনে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের পথ খুলে দিতে পারে,
- যা তাদের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।
📌 এর বিপরীতে, বাংলাদেশের জন্য রাখাইন সীমান্ত হয়ে যায় অস্ত্রধারী বিদ্রোহী, ইয়াবা কার্টেল এবং চোরাচালানকারীদের ‘ফ্রি জোন’।
⚠️ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা না হস্তক্ষেপ?
জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি বিভিন্ন এনজিও:
- পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন প্রকল্প চালায়,
- তবে এসবের মাধ্যমে তারা স্থলভিত্তিক নিরাপত্তা ও প্রশাসনের ওপর পর্যবেক্ষণও রাখে,
- ফলে কখনো কখনো স্থানীয়ভাবে “external eyes” হিসেবে তাদের দেখা হয়।
এছাড়া, মানবিক করিডর, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, ও উন্নয়ন তহবিল এসবের মাঝে গোপন কূটনীতি কাজ করে।
🔍 বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ: করিডর নাকি কৌশল?
বাংলাদেশ এখন এক কঠিন বাস্তবতায়:
- বান্দরবানে নিরাপত্তা জোরদার করতে গিয়ে স্থানীয় অধিকার উপেক্ষা করলে বাড়বে বিক্ষোভ,
- আন্তর্জাতিক করিডর চালু করলে হয়ে যেতে পারে ভূখণ্ডিক দুর্বলতা,
- চীন বা ভারতকে একতরফাভাবে জায়গা দিলে অপরপক্ষের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা,
- আর নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে গিয়ে নিজস্ব কৌশলহীনতা ধরা পড়ে।
🧭 উপসংহার
বান্দরবান এখন আর শুধু পাহাড় বা আদিবাসীদের বাসস্থান নয়— এটি হয়ে উঠেছে একটি ‘সীমান্তের রাজনীতি’, ‘কূটনৈতিক ভারসাম্য’, এবং ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র পরীক্ষাগার।
এখানে বাংলাদেশের অবস্থান— বুদ্ধিদীপ্ত না হলে, কারও হাতের পুতুল, আর কারও দখলের সম্ভাব্য প্রবেশদ্বার হয়ে উঠবে।
⏭️ পরবর্তী পর্ব (পর্ব ৮):
ভবিষ্যতের রূপরেখা ও জাতীয় কৌশলগত করণীয়
– শান্তির সম্ভাবনা
– উন্নয়ন ও সংস্কৃতি রক্ষার ভারসাম্য
– রাষ্ট্র ও জনগণের যৌথ চুক্তির প্রয়োজনীয়তা