চলুন তাহলে শুরু করি পার্বত্য প্রতিচ্ছবি ধারাবাহিকের পর্ব ৬, যেখানে আমরা জানব আধুনিক বান্দরবান ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় অস্ত্র ও মাদক প্রবাহ, KNF ও অন্যান্য নন-স্টেট অ্যাক্টরদের তৎপরতা, এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামোর চ্যালেঞ্জ।
পার্বত্য প্রতিচ্ছবি
পর্ব ৬: আধুনিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
সীমান্ত, অস্ত্র, ও রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির পুনরুত্থান
১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পর অনেকেই ভেবেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ফিরেছে। কিন্তু ২০০০-এর দশকের পর থেকে আস্তে আস্তে পুরনো সংকট নতুন রূপে ফিরে আসতে থাকে— আর এই সংকটের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও কৌশলগত ক্ষেত্র হয়ে ওঠে বান্দরবান।
🗺️ সীমান্তবর্তী এলাকা ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ
বান্দরবান সরাসরি মায়ানমারের রাখাইন ও চিন রাজ্য সংলগ্ন,
যেখানে:
- সীমান্ত জটিল, পাহাড়ি ও কণ্টকাকীর্ণ,
- নিয়মিত অনুপ্রবেশ, অস্ত্র পাচার ও মানবপাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়,
- কোনো কোনো এলাকায় সীমান্ত চিহ্নিত করাও কঠিন, ফলে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল।
এই সীমান্ত এলাকায় বারবার পাওয়া গেছে:
- মায়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি
- আন্তর্জাতিক জঙ্গি বা চরমপন্থীদের স্লিপিং সেল
- এবং চোরাচালান চক্রের প্রবল দাপট
🔫 KNF – কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট: অস্ত্র, আদর্শ ও বিচ্ছিন্নতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বান্দরবানে সবচেয়ে আলোচিত নাম—
📌 KNF (Kuki-Chin National Front)
- এই সংগঠনটি বম ও কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে
- তাদের রয়েছে নিজস্ব অস্ত্রধারী শাখা, প্রশিক্ষণ, এবং কিছু তথ্যমতে বিদেশি সংযোগ
- KNF সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও চাঁদাবাজিমূলক তৎপরতায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে
২০২৩–২৪ সালের মধ্যে KNF-এর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর একাধিক সংঘর্ষ, অপহরণ, মুক্তিপণ, ও বেসামরিক প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে।
💊 মাদক ও অস্ত্র পাচার – ‘সিস্টেমের ভেতরের ছিদ্র’
- বান্দরবান হয়ে মায়ানমার থেকে ইয়াবা, আইস, ও হেরোইনের রুট সক্রিয় রয়েছে।
- একই সঙ্গে অস্ত্র পাচারকারীরা ভারত-মায়ানমার-বাংলাদেশ ত্রৈদেশিক সীমান্তকে ‘অস্ত্র ট্রানজিট জোন’ হিসেবে ব্যবহার করছে।
- স্থানীয় প্রশাসনের কেউ কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও উঠেছে।
এর ফলে:
- পাহাড়ি যুবসমাজের একটা অংশ মাদকের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে
- রাষ্ট্রবিরোধী গ্রুপগুলোর অর্থসংস্থান সহজ হচ্ছে
🪖 রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া – সেনা মোতায়েন, গোয়েন্দা তৎপরতা ও অভিযান
সরকার আধুনিক সময়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে:
- সেনা ও র্যাবের বিশেষ অপারেশন
- KNF ও অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপকে নিষিদ্ধ ঘোষণার চিন্তা
- সীমান্ত এলাকায় চেকপোস্ট, নজরদারি, ও ড্রোন পর্যবেক্ষণ চালু
তবু বাস্তবতা হলো—পার্বত্য এলাকার ভূপ্রকৃতি এবং স্থানীয় জটিল জাতিগত রাজনীতি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে সীমিত করে রাখে।
⚖️ রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সেনা বনাম স্থানীয় সম্পর্ক
- অনেকে বলেন, সেনাবাহিনীই এখন বান্দরবানে প্রকৃত প্রশাসন চালায়,
- বেসামরিক প্রশাসনের ক্ষমতা কার্যত নামমাত্র,
- ফলে স্থানীয়দের মধ্যে আস্থা ও অংশগ্রহণের সংকট তৈরি হয়
এটা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ—কারণ এই পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে নতুন করে বিচ্ছিন্নতাবাদের ভাষা তৈরি করতে পারে।
🧾 উপসংহার
বান্দরবানের ভূরাজনীতি আজ আর কেবল অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়—এটি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক সীমান্ত নিরাপত্তা, জঙ্গি কার্যক্রম, মাদক অর্থনীতি এবং জাতিগত অধিকার প্রশ্নের এক বিস্ফোরক কেন্দ্রবিন্দু।
এখানে প্রয়োজন নিরাপত্তার পাশাপাশি বিশ্বাস, উন্নয়ন এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির সম্মিলিত প্রয়াস। না হলে এখানে শান্তির চেহারা থাকবে, ভিতরে চলবে আগুন।
⏭️ পরবর্তী পর্ব (পর্ব ৭):
আন্তর্জাতিক আগ্রহ ও ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব
- আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও করিডর বিতর্ক
- ভারত, চীন, ও মায়ানমারের কৌশলগত দৃষ্টি
- বাংলাদেশের অবস্থান: কৌশল না আত্মসমর্পণ?