চলুন তাহলে শুরু করি পার্বত্য প্রতিচ্ছবি ধারাবাহিকের পর্ব ৫, যেখানে আমরা জানব ১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি (CHT Accord) সম্পর্কে—এই চুক্তি কি সত্যিই শান্তি নিয়ে এসেছিল, না কি এটি ছিল এক রাজনৈতিক আপস, যার বাস্তবায়ন আজও অসম্পূর্ণ?
পার্বত্য প্রতিচ্ছবি
পর্ব ৫: শান্তিচুক্তি ও তার পরের গল্প (১৯৯৭–বর্তমান)
চুক্তির সম্ভাবনা, বাস্তবতার ধাক্কা ও বিশ্বাসহীনতার ইতিহাস
দীর্ঘ দুই দশকের রক্তাক্ত সংঘাত, দমন-পীড়ন, আর পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় “পার্বত্য শান্তিচুক্তি”। এটি ছিল সেই সময়ের জন্য এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ, যা রাষ্ট্র ও জুম্ম জনগণের মধ্যকার দীর্ঘ দ্বন্দ্বের সমাপ্তির আশাবাদ জাগিয়েছিল।
✍️ শান্তিচুক্তির মূল কাঠামো ও প্রতিশ্রুতি
চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়:
- বাংলাদেশ সরকার (তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার),
- এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (PCJSS)-এর মধ্যে।
চুক্তির প্রধান অঙ্গীকারগুলো ছিল:
- আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদকে কার্যকর ক্ষমতা প্রদান
- সেনা ক্যাম্প ধাপে ধাপে প্রত্যাহার
- বাঙালি পুনর্বাসনের নিয়ন্ত্রণে ভূমি কমিশনের কার্যকারিতা
- আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ
- পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ ও সমন্বিত শাসনব্যবস্থা
🕊️ চুক্তির পরের সম্ভাবনা ও কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি
- কিছু সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়,
- আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়,
- অস্ত্রধারী শান্তিবাহিনী আত্মসমর্পণ করে,
- পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির বাতাস বইতে শুরু করে।
এই সময় অনেকেই ভাবতে শুরু করে— পাহাড়ে নতুন সূর্য উঠছে।
❗ বাস্তবায়নের অসম্পূর্ণতা ও রাজনৈতিক দ্বিচারিতা
কিন্তু কাগজে থাকা অঙ্গীকার বাস্তবে রূপ পায়নি।
- ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত ভূমি কমিশন কার্যকর হয়নি
- সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার থেমে যায়
- পাহাড়ে অস্ত্রধারী গ্রুপ ও ভিন্নমতের দল গঠিত হয়
- আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থ হয়, কারণ প্রকৃত প্রশাসনিক কর্তৃত্ব থেকে যায় রাজধানীর হাতে
চুক্তির অন্যতম স্পষ্ট ব্যর্থতা হলো—
বাঙালি বনাম পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা তৈরির কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
⚠️ চুক্তির ভেতরে লুকানো দোলাচল
- অনেক বাঙালি মনে করেন, এই চুক্তি তাদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।
- অন্যদিকে পাহাড়িরা মনে করেন, চুক্তি শুধু তাদের অস্ত্র নামাতে বাধ্য করেছে, অধিকার দেয়নি।
- ফলে দুইপক্ষই একে আধা-চুক্তি, বা ‘কাগুজে শান্তি’ বলে আখ্যায়িত করে।
🧩 পাহাড়ি রাজনীতিতে বিভাজন
চুক্তির পরে PCJSS ভেঙে তৈরি হয় নতুন গ্রুপ:
- United People’s Democratic Front (UPDF)
- পরে KNF (Kuki-Chin National Front) সহ আরও সশস্ত্র ও রাজনৈতিক গ্রুপ উঠে আসে
এই গ্রুপগুলো চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং নিজেদের মতো করে অস্ত্র ও আদর্শ নিয়ে সক্রিয় হয়।
🧾 উপসংহার
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলেও, তার বাস্তবায়নের গাফিলতি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আজও পাহাড়ি জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অনাস্থা তৈরি করে রেখেছে।
চুক্তি স্বাক্ষর করা সহজ ছিল, কিন্তু বিশ্বাস তৈরি করা কঠিন— এবং বিশ্বাসহীনতার এই সংকটই চুক্তির পরবর্তী অধ্যায়ে রক্তপাত ও দ্বন্দ্ব ফিরিয়ে এনেছে।
⏭️ পরবর্তী পর্ব (পর্ব ৬):
আধুনিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট – সীমান্ত, অস্ত্র, ও কৌশলগত উত্তেজনা
– KNF ও চীনের প্রসঙ্গ
– অস্ত্র পাচার ও মাদক সংযোগ
– সীমান্ত রাজনীতির নতুন বাস্তবতা