চলুন তাহলে শুরু করি পার্বত্য প্রতিচ্ছবি ধারাবাহিকের চতুর্থ পর্ব —যেখানে আমরা আলোচনা করবো স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্নে বান্দরবানসহ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে কীভাবে সংকট ঘনীভূত হয়, কীভাবে শান্তিবাহিনী ও জাতিগত দ্বন্দ্বের বিস্তার ঘটে, এবং কীভাবে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা জন্ম নেয়।
পার্বত্য প্রতিচ্ছবি
পর্ব ৪: স্বাধীন বাংলাদেশে সংকটের সূচনা (১৯৭২–১৯৯০)
জুম্ম অধিকার আন্দোলন, শান্তিবাহিনী ও রাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগ
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে পাহাড়ি জনজাতিরাও আশাবাদী ছিল— কিন্তু এই আশার পর্দা দ্রুত ফেটে যায়। সংবিধানে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের স্বীকৃতি না পেয়ে একটি জাতিগোষ্ঠী বঞ্চনার নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ওঠে।
🇧🇩 সংবিধান এবং আদিবাসীদের প্রত্যাখ্যান
১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি নির্ধারিত হয়— গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
এই “বাঙালি জাতীয়তাবাদ” শব্দটি পাহাড়ি জনগণের চোখে নিজেদের অস্তিত্ব বিলুপ্তির আশঙ্কা হিসেবে দেখা দেয়।
- পাহাড়িরা জাতিগতভাবে বাঙালি নয়,
- তাদের নিজস্ব ভাষা, ধর্ম (বিশেষত বৌদ্ধ), পোশাক, সমাজব্যবস্থা রয়েছে,
- ফলে তারা “জুম্ম” নামক একটি পৃথক পরিচয়ের দাবিতে সংগঠিত হতে শুরু করে।
🪧 PCJSS এবং জুম্ম অধিকার আন্দোলনের সূচনা
১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা গঠন করেন:
📌 Parbatya Chattagram Jana Samhati Samiti (PCJSS)
PCJSS-এর দাবিগুলো ছিল:
- পাহাড়িদের আদিবাসী পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি,
- পার্বত্য অঞ্চলের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন,
- পাহাড়ি সংস্কৃতি, ভাষা, ভূমির অধিকারের রক্ষা,
- এবং সেনা মোতায়েন প্রত্যাহার।
সরকার এই দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করে। পরিণতিতে, PCJSS গঠন করে সশস্ত্র শাখা:
📌 Shanti Bahini (শান্তিবাহিনী)
🔫 শান্তিবাহিনী ও সংঘাতের বিস্তার
১৯৭৬–৯০ সময়কালে:
- শান্তিবাহিনী পার্বত্য এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ,
- চাঁদাবাজি, অপহরণ, এবং রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা চালায়,
- পাহাড়ে তৈরি হয় “আন্তরিক রাষ্ট্রবিরোধী অঞ্চল”,
- সরকার বান্দরবানে ও পার্বত্য এলাকায় সেনা ঘাঁটি, চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে।
🏚️ বাঙালি পুনর্বাসন নীতি ও পাহাড়িদের বঞ্চনা
১৯৭৯ থেকে শুরু হয় পাহাড়ে বাঙালি মুসলমান পুনর্বাসন কর্মসূচি।
সরকার পাহাড়িদের ভূমিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি বসতি স্থাপন করে।
ফলে:
- পাহাড়িরা ভূমিহীন হয়ে পড়ে,
- শুরু হয় পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা,
- জন্ম নেয় জাতিগত ঘৃণা ও শত্রুতা।
🧨 সেনা বনাম জনতা বাস্তবতা
পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত সেনাবাহিনী এক সময় হয়ে ওঠে:
- পাহাড়িদের চোখে শত্রু বাহিনী,
- আর সরকারের চোখে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার একমাত্র ভরসা।
ফলে এখানে জনগণ বনাম রাষ্ট্র সম্পর্ক ভয়ংকর রূপ নেয়।
💔 মানবেন্দ্র লারমার মৃত্যু ও সংকটের গভীরতা
১৯৮৩ সালে মানবেন্দ্র লারমা নিজ দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধে নিহত হন। এই ঘটনার পর পাহাড়ি রাজনীতি আরও জটিল ও বিভক্ত হয়ে পড়ে।
🧾 উপসংহার
১৯৭২ থেকে ১৯৯০—এই সময়কালে বান্দরবান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে ওঠে একটি অঘোষিত যুদ্ধাঞ্চল।
পাহাড়িদের অধিকারচ্যুতি, সরকারি অবজ্ঞা, এবং সামরিক শক্তির একচেটিয়া প্রয়োগ— সব মিলিয়ে তৈরি হয় এমন এক সংকট, যার সমাধানে প্রয়োজন হয় পরবর্তী সময়ে একটি ঐতিহাসিক চুক্তির।
⏭️ পরবর্তী পর্ব (পর্ব ৫):
পার্বত্য শান্তিচুক্তি ১৯৯৭—সত্যিকারের শান্তি, না অব্যক্ত প্রতারণা?
- চুক্তির ধারা
- বাস্তবায়নের রাজনৈতিক নাটক
- পাহাড়িদের প্রতিক্রিয়া ও বর্তমান বাস্তবতা