চলুন আমরা এগিয়ে যাই পার্বত্য প্রতিচ্ছবি সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে— যেখানে আমরা জানবো ঔপনিবেশিক শাসনামলে বান্দরবান কেমন ছিল, কিভাবে ব্রিটিশ শাসকরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে দেখত, এবং সেই শাসনব্যবস্থা ভবিষ্যতের সংকটের বীজ কিভাবে বপন করে।
পার্বত্য প্রতিচ্ছবি
পর্ব ২: ঔপনিবেশিক যুগে বান্দরবান ও শাসননীতি
১৮৬০ সাল। ব্রিটিশরা চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের দিকে নজর দেয়। তাদের দৃষ্টিতে এটি ছিল এক রহস্যময়, প্রায়-অদৃশ্য ভূখণ্ড— জানার আগ্রহ যেমন, শাসনের অসুবিধাও তেমন।
এভাবেই শুরু হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম, বিশেষ করে বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িকে পৃথক শাসন কাঠামোর আওতায় আনার সূচনা।
চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল, ১৯০০
এই আইনটি পার্বত্য অঞ্চলের শাসনব্যবস্থাকে মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করে দেয়।
- এর মাধ্যমে বান্দরবান সহ পুরো পার্বত্য অঞ্চলকে ঘোষণা করা হয় ‘Excluded Area’,
অর্থাৎ, এখানকার মানুষের ওপর বাঙালি মুসলিম বা হিন্দুদের বসতি ও মালিকানা নিষিদ্ধ। - ভূমি, রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা—সবই পরিচালিত হতো স্থানীয় প্রথাগত রাজার (Chief’s Circle) মাধ্যমে।
বান্দরবানে যেমন ছিল বোমাং সার্কেল। - সাধারণ প্রশাসনিক নিয়ম-কানুন এখানে চালু ছিল না, এমনকি ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটরা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেন না।
‘Divide & Administer’ – শাসনের ব্রিটিশ কৌশল
ব্রিটিশ শাসকেরা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বাঙালিদের থেকে পৃথক রেখেছিল দুই কারণে:
- আদিবাসী সংস্কৃতিকে কৌশলগতভাবে আলাদা রাখা।
– যেন তারা ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদে যুক্ত না হয়। - ভবিষ্যৎ সংঘাত বা বিভাজন পরিস্থিতিতে ব্যবহারযোগ্য ‘কন্ট্রোলড গ্রুপ’ হিসেবে প্রস্তুত রাখা।
এই নীতির ফলেই পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ একদিকে নিজেদের পৃথক পরিচয় নিয়ে গড়ে উঠেছিল, অন্যদিকে জাতীয় মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথ হয়ে গিয়েছিল কণ্টকাকীর্ণ।
বান্দরবানে রাজা ব্যবস্থা ও সার্কেল প্রশাসন
বান্দরবানে তখন বোমাং রাজা ছিলেন প্রধান প্রশাসনিক প্রতিনিধি।
- তার অধীনে ছিল ৯৭টি মৌজা।
- রাজা → হেডম্যান → কারবারি → সাধারণ জনগণ
এই কাঠামোয় সামাজিক ও প্রশাসনিক কাজ চলতো।
ব্রিটিশরা স্থানীয় রাজাকে কর সংগ্রহের দায়িত্ব দিতো, এবং বিনিময়ে তার প্রশাসনকে আদালত, বিচার, ভূমি বিতরণ ইত্যাদিতে পূর্ণ কর্তৃত্ব দিতো।
এখানে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন প্রায় ছিলই না—এমনকি একজন বাঙালি নাগরিকও পাহাড়ে বসতি নিতে পারতেন না।
ব্রিটিশ নীতির পরিণতি: বিচ্ছিন্নতা বনাম পরিচয়
এই ব্যবস্থার ইতিবাচক দিক ছিল:
- আদিবাসীরা নিজেদের ভাষা, ধর্ম, সমাজ কাঠামো ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে পেরেছিল।
কিন্তু নেতিবাচক দিক ছিল মারাত্মক:
- তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মূলধারার বাইরে থেকে গিয়েছিল।
এই ঐতিহাসিক বিচ্ছিন্নতা ভবিষ্যতে সৃষ্টি করে:
- জাতীয়তাবাদ বনাম আঞ্চলিকতা,
- আত্মপরিচয় বনাম রাষ্ট্রীয় শাসন এর দ্বন্দ্ব।
উপসংহার
পার্বত্য বান্দরবানকে ব্রিটিশরা তাদের সুবিধামতো ‘আলাদা করে রেখে’ শাসন করেছিল। তারা না চেয়েছিল সম্পৃক্ততা, না চেয়েছিল সহমর্মিতা— শুধু প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহারের উপযোগিতা।
এই শাসন কাঠামোই ছিল ভবিষ্যতের বিরোধ, ক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের সূচনা বিন্দু।
পরবর্তী পর্বে (পর্ব ৩):
পাকিস্তান আমলে বান্দরবান: রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও সামরিকীকরণের শুরু।